নীরব নিপীড়ন: গুমের ছায়ায় বাংলাদেশ

ভূমিকা:
বাংলাদেশে গুম কেবল নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা নয়—এ এক নীরব, গভীর ও প্রাতিষ্ঠানিক নিপীড়নের গল্প। সম্প্রতি গঠিত অন্তর্বর্তী গুম তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন এক বাস্তবতা, যেখানে আইন রক্ষাকারী বাহিনীর ছায়াতলে বহু মানুষ নিখোঁজ হয়েছে, আর এই অপকর্ম যেন ‘অপারেশনাল সংস্কৃতি’র অংশে পরিণত হয়েছিল।


গুম: একক ব্যক্তি নয়, কাঠামোর কাজ
প্রতিবেদন বলছে, গুমের ঘটনা ছিল না কোনো একক ব্যক্তির অপকর্ম। বরং নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর অভ্যন্তরে একটি সাংগঠনিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, যেখানে নিরুদ্দেশ করাকে নীরবে মেনে নেওয়া হতো। অপরাধীরা ছিল সুরক্ষিত, আর বিচার ছিল অনুপস্থিত।

নথিতে গুম নেই, কিন্তু রাজনৈতিক পরিচয় আছে
যেসব নথি কমিশনের হাতে এসেছে, সেগুলোর কোথাও ‘গুম’ শব্দটি নেই। কিন্তু ছিল নিখোঁজ ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয়, আত্মীয়দের নাম, এমনকি ঘনিষ্ঠদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিবরণ। দুর্নীতি বা শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ থাকলেও ‘নিপাত’ বা ‘নিহত’ হওয়ার তথ্য গোপন রাখা হয়েছে।

পুরস্কার পাচ্ছে অপরাধী, বিচার নয়
একাধিক ঘটনায় দেখা গেছে, যারা গুমে জড়িত ছিলেন, তাদের পদোন্নতি ও প্রশংসা দেওয়া হয়েছে। এমনকি এক কর্মকর্তাকে ‘খুব দক্ষ, সৎ ও নেতৃত্বগুণে পরিপূর্ণ’ বলে প্রশংসা করেন তৎকালীন র‌্যাব প্রধান বেনজীর আহমেদ, যিনি পরবর্তীতে পুলিশ মহাপরিদর্শক হন।

‘অপারেশন’-এর পর টাকা আর তওবা
গুমের পর অভিযানে অংশ নেওয়া সদস্যদের মাঝে টাকা বিতরণ করা হতো। কেউ কেউ সেই অর্থ দান করে নিজেকে মুক্ত রাখতে চাইতেন। কেউ কেউ নামাজে মন দিতেন, কিন্তু সিনিয়ররা তাদের বলতেন, “মানুষের হক নষ্টের পাপ আল্লাহও মাফ করেন না।”

ভয় আর বাধ্যতার মধ্যে তরুণরা
নতুন কর্মকর্তারা এসব কাজের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস পেতেন না। কেউ পালানো বন্দিকে ফের ধরতে গিয়ে প্রাণভয়ের কথা বলেছেন। কেউ বলেছেন, “শুরুর সময় ‘না’ বলার সাহস ছিল না, এখন আর পেছনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই।”

তদন্ত নয়, নীরবতা
সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, কোনো সিনিয়র কর্মকর্তা এসব অপরাধ শুনেও তদন্ত শুরু করেননি। বরং, এসব ঘটনার কথা তুলে ধরে তারা নিজেদের সাবধানতা বা অভিজ্ঞতার প্রমাণ দিতে চেয়েছেন।

পুলিশেও একই চিত্র
শুধু সেনা বা র‌্যাব নয়, পুলিশের মধ্যম সারির কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন—তাদের জোর করে এমন নথিতে স্বাক্ষর করানো হতো, যা তাদের গুমের মতো অপরাধে যুক্ত করে ফেলত।


উপসংহার:
এই প্রতিবেদন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনার দলিল নয়—এ এক রাষ্ট্রীয় নীরবতার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা নির্মম বাস্তবতা। গুম কোনো ব্যক্তিগত বিচ্যুতি নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ছায়ায় গড়ে ওঠা এক নির্মম বাস্তবতা। এখন প্রশ্ন, এই সত্য উদ্ঘাটনের পর রাষ্ট্র কি এর দায় নেবে? নাকি আবারও নীরবতা চাপা দেবে সত্যকে?

Scroll to Top