ইসলাম ধর্মে মহররমের ১০ তারিখ বা আশুরা দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ দিনে অনেক ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক ঘটনার স্মরণ রয়েছে। তবে ইসলামের সুশৃঙ্খল শরিয়ত ব্যবস্থা আশুরার নামে যেসব বিদআতপূর্ণ কর্মকাণ্ড চালু হয়েছে—বিশেষ করে ‘মাতম’ বা শোক পালনের চর্চা—তা শরিয়তসম্মত নয়।
🔹 আশুরা উপলক্ষে মাতম—ইতিহাস ও উদ্ভব
ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য বিবরণ অনুযায়ী, হজরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদতের পর প্রথম ৩০০ বছর পর্যন্ত আশুরা উপলক্ষে মাতম বা বুক চাপড়ানোর প্রচলন ছিল না। এমনকি সেই সময় সাহাবায়ে কেরাম ও তাবিয়িনদের অনেকে জীবিত ছিলেন—কিন্তু কারও কাছেই এমন কোনো আচরণের নজির নেই।
ইতিহাসবিদ ইমাম ইবনুল আসির (রহ.) তার বিখ্যাত গ্রন্থ আল-কামিল ফিত্ তারিখ (খণ্ড: ৭, পৃষ্ঠা: ২৭৯)-এ উল্লেখ করেছেন:
“হিজরি ৩৫২ সালে শিয়া শাসক মুইজ্জুদ দাওলা দাইলামি বাগদাদে প্রথম আশুরা উপলক্ষে মাতমের প্রচলন করেন।”
এরপর মিশরে হিজরি ৩৬৩ সালে শিয়া ফাতেমি খলিফা আল-মুইজ্জু লিদিনিল্লাহ এই প্রথাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে চালু করেন। এর আগে মুসলিম সমাজে এ রকম কোনো আয়োজনের অস্তিত্ব ছিল না।
🔹 শিয়া লেখকদের বক্তব্য
শিয়াদের মধ্যেও কিছু চিন্তাশীল লেখক ও ইতিহাসবিদ স্বীকার করেছেন যে, আশুরার ‘মাতম’ পরবর্তীতে যোগ হওয়া এক বিদআত। যেমন:
✅ আমির আলী শিয়া তার বই The Spirit of Islam–এ লেখেন:
“Muiz-ud-Dowla also instituted the yeum-i-aashura, the day of mourning, in commemoration of the martyrdom of Hussain and his family on the plains of Kerbela.”
✅ একইভাবে তার আরেক গ্রন্থ History of the Saracens–এ বলা হয়েছে:
“He was a Shiah; and it was he who established the 10th day of the Moharram as a day of mourning in commemoration of the massacre of Kerbala.”
✅ শিয়া ঐতিহাসিক শাকির হুসাইন নাকভি-র মুজাহিদে আজম বইতেও (পৃষ্ঠা ৩৩২) এ বিষয়ে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়।
🔹 শরিয়তের দৃষ্টিতে করণীয় ও বর্জনীয়
✅ করণীয়:
- আশুরার দিনে রোজা রাখা। রাসুল (সা.) এ দিনকে সম্মান করে ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ মহররমে রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
- তাওবা, ইবাদত ও দোয়া করা।
- কারবালার শহীদদের জন্য দোয়া ও সম্মান প্রদর্শন।
❌ বর্জনীয়:
- বুক চাপড়ানো, মাতম করা, ছুরি বা ব্লেড দিয়ে শরীর জখম করা।
- কালো কাপড় পরে শোক পালন।
- রাস্তায় শোকমিছিল করা।
- গান-বাজনা ও নাট্যরূপে কারবালার ঘটনা উপস্থাপন।
🔹 হাদিস ও ফিকহবিদদের মতামত
✅ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু আবিষ্কার করল যা এর অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত হবে।”
— (সহিহ্ বুখারি ও মুসলিম)
✅ ইমাম ইবনে কাসির (রহ.) আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া (১৫/২৬১)-তে এই বিদআতের সূচনা এবং পরবর্তী বিস্তার নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন।
✅ সমকালীন গবেষক মাওলানা হাবিবুর রহমান আজমি (রহ.) তার গ্রন্থ ইবতালে আজাদারি-তে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন—এটা ইসলামি শরিয়তের পরিপন্থী।
🔚 উপসংহার
আশুরা কোনো শোক দিবস নয়; বরং তা আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়ার প্রতীক। হজরত হুসাইন (রা.)-এর আত্মত্যাগ আমাদের জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা—মাতম বা আহাজারির অনুমতি নয়। ইসলামের প্রকৃত রূপ বজায় রাখতে আমাদের দরকার ইতিহাসভিত্তিক সঠিক জ্ঞান, শরিয়তের নির্দেশনার প্রতি আনুগত্য এবং বিদআত থেকে মুক্ত থাকা।
“আসুন, মাতম নয়—আশুরাকে উপলক্ষ করে আত্মশুদ্ধির পথে অগ্রসর হই।”
– ইনশা আল্লাহ।