বিদেশি ব্যাংকের খেলাপিও সিআইবিতে: পালাবদলের পর কঠোর হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক

ঢাকা, ২১ জুন:
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন গভর্নরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে একের পর এক কঠোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এবার প্রথমবারের মতো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণখেলাপি হওয়া দেশীয় ব্যক্তি ও কোম্পানিকে ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) ডেটাবেইসে তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে।

সিআইবির সফটওয়্যার হালনাগাদ, শিগগিরই যুক্ত হবে বিদেশি খেলাপিরাও
বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইনে বিদেশি ব্যাংকের কাছে খেলাপি হওয়া প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে সিআইবিতে দেখানোর সুযোগ না থাকলেও, নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের নির্দেশনায় এই সীমাবদ্ধতা দূর করে সিআইবির সফটওয়্যার হালনাগাদ করা হচ্ছে।

প্রাথমিকভাবে কানাডা, জার্মানি, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, রাশিয়া ও চেক প্রজাতন্ত্রের কিছু ব্যাংকের কাছে খেলাপি হওয়া দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য সিআইবিতে অন্তর্ভুক্ত করার কাজ চলছে। এই প্রক্রিয়া আগামী সেপ্টেম্বর থেকে পুরোদমে কার্যকর হতে পারে।

যাঁরা তালিকাভুক্ত হবেন, তাঁদের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ
সিআইবিতে বিদেশি ব্যাংকের কাছে খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান:

নতুন কোনো ব্যাংক ঋণ পাবেন না

ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না

জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না

যেসব বড় কোম্পানি তালিকায়
সংশ্লিষ্ট সূত্র অনুযায়ী, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে খেলাপি হওয়া অন্তত ১১টি বড় দেশীয় কোম্পানির নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে:

বেক্সিমকো গ্রুপ:
জার্মানির আইএনজি ব্যাংক থেকে নেওয়া ৩৩ মিলিয়ন ইউরোর ইসিএ টার্ম লোন খেলাপি হয়েছে। ব্যাংকটি বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-কে এ বিষয়ে চিঠিও দিয়েছে।

দেশবন্ধু গ্রুপ:
চেক প্রজাতন্ত্রের চেকোস্লোভাকিয়া ওবখোদিনি বানকা থেকে নেওয়া ৪.১০ মিলিয়ন ইউরোর বায়ার্স ক্রেডিট ফেরত না দেওয়ায় দিল্লিস্থ চেক দূতাবাসের মাধ্যমে অভিযোগ এসেছে।

সামিট ও এসএস পাওয়ার:
সিঙ্গাপুরভিত্তিক ব্যাংকের কাছে খেলাপি হয়েছেন।

তালিকায় সামিট পাওয়ার, এসএস পাওয়ার ও আরও কয়েকটি বৃহৎ গ্রুপের নাম রয়েছে, যাঁরা বিদেশে একাধিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করেননি।

বিদেশি ঋণও পরিশোধ করছে সরকার
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন,

“অনেক ক্ষেত্রে বিদেশি ঋণের গ্যারান্টি দেয় সরকার। প্রতিষ্ঠানগুলো সময়মতো পরিশোধ না করায় সেই দায় শেষ পর্যন্ত সরকারের কাঁধে পড়ে।”

গত বছর ডিসেম্বর শেষে দেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ১০,৩৬৩ কোটি ডলার, যার মধ্যে ১,৯৪২ কোটি ডলার বেসরকারি খাতে। ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত সরকারি ঋণের পরিমাণ ৮৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

সিআইবিতে ইচ্ছাকৃত খেলাপির জন্য আলাদা শ্রেণিবিন্যাস
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, শুধু বিদেশি ঋণ খেলাপির তথ্যই নয়, সিআইবির নতুন ডেটাবেইসে ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি’ হিসেবে আলাদা ক্যাটাগরি সংযুক্ত করা হচ্ছে, যাতে যথাযথভাবে নীতিমালা প্রয়োগ করা যায়।

সিপিডি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন,

“এ উদ্যোগ অত্যন্ত সময়োপযোগী। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর দেশি-বিদেশি খেলাপিদের মধ্যে কোনো বৈষম্য রাখা সম্ভব নয়।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন,

“গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। দেশি হোক বা বিদেশি, সবাইকে সিআইবিতে আনতে হবে। যাতে কেউ খেলাপি হয়ে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক বা অর্থনৈতিক সুবিধা নিতে না পারে।”

বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে এ ধরনের জবাবদিহিমূলক উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটি কার্যকর করতে হলে সফটওয়্যার হালনাগাদ, আইনি সহায়তা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার সমন্বিত প্রয়োগ দরকার।

Scroll to Top