নিজস্ব প্রতিবেদক | চট্টগ্রাম | ২৩ জুন ২০২৫
চট্টগ্রাম বন্দরের অন্যতম আলোচিত নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অবশেষে সরে যাচ্ছে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড। আগামী ৬ জুলাই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (CPA) আর চুক্তি নবায়নের পথে হাঁটছে না। ফলে দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময়ের একচেটিয়া আধিপত্যের অবসান ঘটছে।
বন্দর সূত্র জানায়, সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে এনসিটি আপাতত নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রাথমিক প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বন্দরের মেকানিক্যাল ও ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে সাইফ পাওয়ারটেকের কাছ থেকে কাজ বুঝে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।
নীতিগত সিদ্ধান্ত ও পরবর্তী পদক্ষেপ
১৮ জুন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে এনসিটি পরিচালনা সংক্রান্ত বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এতে বলা হয়, নতুন করে বেসরকারি অপারেটর নিয়োগের জন্য দরপত্র প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ হওয়ায়, আমদানি-রপ্তানির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে আপাতত বন্দর নিজেই দায়িত্ব নেবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের চিফ পারসোনেল অফিসার ও মুখপাত্র নাসির উদ্দিন জানান,
“টার্মিনাল পরিচালনায় ব্যয় নির্বাহের জন্য মন্ত্রণালয়ে আর্থিক অনুমোদনের আবেদন পাঠানো হয়েছে। অনুমতি পেলেই পূর্ণাঙ্গভাবে কাজ শুরু হবে।”
সাইফ পাওয়ারটেকের দীর্ঘ একচেটিয়া দখলদারি
২০০৫ সালে যাত্রা শুরু করা সাইফ পাওয়ারটেক শুরুতে শুধুমাত্র যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করত। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রতিষ্ঠানটির প্রভাব নাটকীয়ভাবে বাড়ে। অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতাদের ছায়াতলে থেকে প্রতিষ্ঠানটি টেন্ডার ছাড়াই বছরের পর বছর বন্দর চুক্তি পেয়ে এসেছে।
এমনকি কোনো সময় টেন্ডার হলেও নীতিমালায় এমন শর্ত সংযোজন করা হতো, যা সাইফ পাওয়ারটেক ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারত না।
পর্দার আড়ালে রাজনীতি ও প্রভাবশালী লবিং
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার মো. রুহুল আমিন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। সেই ঘনিষ্ঠতাই তাকে বন্দরের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছাড়াও দেশের আরও বড় বড় প্রকল্পে প্রবেশাধিকার দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এনসিটি বিদেশিদের হাতে না দেওয়ার নামে যে আন্দোলন সাম্প্রতিক সময়ে হয়েছে, অনেকেই একে সাইফ পাওয়ারটেককে রক্ষার কৌশল হিসেবে দেখছেন।
বিশ্লেষণ: টার্মিনাল পরিচালনায় বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত
চট্টগ্রাম বন্দরের মতো দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনায় এতদিন ধরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। এখন সরকারের নীতিগত অবস্থান পরিবর্তন এবং প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে ফেরত আনার পদক্ষেপ শুধু সাইফ পাওয়ারটেকের প্রভাব কমানো নয়, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির দিকেও অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
এতে শুধু বন্দর ব্যবস্থাপনাই নয়, সরকারি প্রকল্পে ক্ষমতাকেন্দ্রিক বাণিজ্যের সংস্কৃতির বিরুদ্ধেও একটি বার্তা যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।